বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা রাজনৈতিক নয়: প্রধানমন্ত্রী

জাতীয়, 19 April 2024, 725 Views,
ফাইল ছবি

অনলাইন ডেস্ক :
বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক কোনো মামলা নয় জানিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, অগ্নিসন্ত্রাস, অস্ত্রপাচার, গ্রেনেড হামলাসহ বিভিন্ন অপরাধের মামলা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। তারা অপরাধ করেছে, আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

banner

আজ ১৯ এপ্রিল শুক্রবার সকালে গণভবনে কৃষক লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে সংগঠনটির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন।

আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ হাসিনা বলেন, আজকে (বিএনপি) সব জায়গায় কান্নাকাটি, বলছে তাদের বিরুদ্ধে মামলা। তাদের জিজ্ঞেস করতে হবে মামলাগুলো কীসের মামলা? …অগ্নিসন্ত্রাস, অস্ত্রপাচার, গ্রেনেড হামলাসহ বিভিন্ন অপরাধের মামলা। তারা অপরাধ করেছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সেটাই তো বাস্তবতা।

তিনি বলেন, তারা তিন হাজার ৮০০ গাড়ি পুড়িয়েছে, বাস, লঞ্চ, রেল পুড়িয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে মামলা হবে না তো কী হবে? ওদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা তো পলিটিক্যাল (রাজনৈতিক) মামলা না, প্রত্যেকটা মামলা হচ্ছে অগ্নিসন্ত্রাসের মামলা, তারা মানুষ হত্যা করেছে আগুন দিয়ে, ২৮ অক্টোবর যে ঘটনা তারা ঘটালো, নির্বাচন ঠেকাতে গিয়ে রেলে আগুন দিয়ে মা-শিশুকে পুড়িয়ে মেরেছে, যারা এগুলো করলো তাদের বিরুদ্ধে কি মামলা হবে না? তাদের কি মানুষ পূজা করবে?

এসব মামলার বিচারকাজ আরও দ্রুত শেষ করে জড়িতদের শাস্তি দিয়ে দেওয়া উচিত বলেও মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী।

আওয়ামী লীগ প্রতিশোধপরায়ণ নয় বিধায় বিএনপি এখনো কথা বলার সুযোগ পাচ্ছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, তাদের ভাগ্য ভালো আমরা ক্ষমতায় আছি, আমরা তাদের মতো প্রতিশোধপরায়ণ না দেখে তারা এখনো কথা বলার সুযোগ পায়। তারা সারাদিন কথা বলে মাইক লাগিয়ে, তারপর বলবে কথা বলার সুযোগ পায় না।

বিরোধী দলে থাকার সময়কার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ অফিসে তো আমরা ঢুকতেই পারতাম না। কীভাবে তারা অত্যাচার করেছে আমাদের ওপর, আমরা তো তার কিছুই করিনি। আমরা প্রতিশোধ নিতে ব্যস্ত থাাকিনি। আমরা আমাদের সব শক্তি-মেধা কাজে লাগিয়েছি দেশের উন্নয়নে, দেশের মানুষের জন্য কাজ করতে।

সারাদেশের জেলের সব অপরাধীই বিএনপির দলীয় কি না, এমন প্রশ্ন রেখে আওয়ামী লীগ প্রধান বলেন, তারা (বিএনপি) যেভাবে বলছে ৬০ লাখ লোক তাদের গ্রেপ্তার, ৬০ লাখ তো আমাদের জেলের ধারণক্ষমতাও নেই। তারপরও যতটুকু ধারণক্ষমতা আছে, সবই বিএনপির লোক- এটাই তো তারা বলতে চাচ্ছে। তার মানে বাংলাদেশে যত অপরাধ সব অপরাধ করে বিএনপি।

তিনি বলেন, কান্নাকাটি করে সব জায়গায় বলছে এত লক্ষ লোক তাদের গ্রেপ্তার। আমাদের সারা দেশে যত জেলখানা আছে সেখানে যে ধারণক্ষমতা, তারা যত লক্ষ গ্রেপ্তার বলছে, সব লোক যদি তাদের ধরা থাকে, তাহলে তো জেলে অন্য কোনো অপরাধী আর নেই। যত অপরাধী আছে জেলে, সব অপরাধীই বিএনপির। সেখানে চুরি, ডাকাতিসহ যা আছে, ওদের হিসেবে সব অপরাধী হচ্ছে বিএনপির। ওরাই সব, এটাই তো বলতে চাচ্ছে।

বিভিন্ন সময় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের ওপর অত্যাচারের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, আজকে তারা চিৎকার করে তাদের ওপর অত্যাচার… কী অত্যাচার হচ্ছে তাদের ওপর? তারা যে অত্যাচার করেছে, সেই জিয়াউর রহমানের ক্ষমতায় আসার পর থেকে আওয়ামী লীগের ওপর অত্যাচারের যে স্টিম রোলার চালিয়েছিল, যেভাবে হত্যা করেছিল, খালেদা জিয়া আসার পরে ২০০১ সালের নির্বাচনের পর কোনো আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী ঘরে থাকতে পারেনি।

তিনি আরও বলেন, ধরে নিয়ে যেভাবে অত্যাচার এবং আমাদের কতগুলো নেতাকে মেরে ফেলে দিল, আহসান উল্লাহ মাস্টার থেকে শুরু করে আমাদের বহু নেতা-কর্মীকে হত্যা করেছে। …ওরা শুধু আওয়ামী লীগ নয়, ওরা মানুষের ওপর যেভাবে অত্যাচার করেছে।

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে দলের কেন্দ্রীয় নেতা-কর্মীদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে শুভেচ্ছা জানান সংগঠনের সভাপতি কৃষিবিদ সমীর চন্দ ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক বিশ্বনাথ সরকার বিটু।

১৯৭২ সালের এই দিনে (১৯ এপ্রিল) জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষক লীগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

Leave a Reply

নবীনগরে সড়ক দুর্ঘটনায় একজন নিহত

চলারপথে রিপোর্ট : ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগরে প্রাইভেটকার ও ট্রাক্টরের সঙ্গে Read more

প্রতিপক্ষের হামলায় নারী নিহত, দুইজন আটক

চলারপথে রিপোর্ট : তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের হামলায় খাইরুন Read more

গাজীপুরে মামা হত্যার আসামি ভাগিনা গ্রেফতার

চলারপথে রিপোর্ট : গাজীপুরে আনিসুর রহমান হত্যার মামলার আসামি ভাগিনা Read more

সদর মডেল থানায় যোগদান করেই কঠোর…

সঞ্জীব ভট্টাচার্য্য : আজহারুল ইসলাম সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর মডেল থানায় Read more

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ব্যবসায়ীর লাশ উদ্ধার

চলারপথে রিপোর্ট : ফ্ল্যাট বাসা থেকে শরীর মীর (৪০) নামের Read more

নাসিরনগরে বাবাকে হত্যার ঘটনায় ছেলে আটক

চলারপথে রিপোর্ট : নাসিরনগরে আলম মিয়া (৬০) নামের এক ব্যবসায়ী Read more

আখাউড়ায় খেলাফত মজলিসের প্রার্থীর মতবিনিময়

মোঃ ইসমাইল: ব্রাহ্মণবাড়িয়া- ৪ (কসবা-আখাউড়া) আসনের খেলাফত মজলিস মনোনীত প্রার্থী Read more

৫০ কেজি গাঁজাসহ একজন গ্রেফতার

চলারপথে রিপোর্ট : ৫০ কেজি গাঁজা ও ১টি সিএনজি উদ্ধারসহ Read more

কাপ্তাই হ্রদের পানি বিপদসীমায়, জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের…

অনলাইন ডেস্ক : বর্ষার শেষপ্রহরে নেমে আসা অবিরাম বৃষ্টি ও Read more

ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর থানার নতুন ওসি আজহারুল…

চলারপথে রিপোর্ট : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে Read more

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে…

অনলাইন ডেস্ক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে ঐতিহাসিক Read more

কুমিল্লার দাউদকান্দিতে ইউপি চেয়ারম্যান গ্রেফতার

চলারপথে রিপোর্ট : কুমিল্লার দাউদকান্দি বারপাড়া ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত) Read more

মজুদদারির বিরুদ্ধে ডিসিদের কঠোর হওয়ার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর

জাতীয়, 3 March 2024, 751 Views,
ফাইল ছবি

অনলাইন ডেস্ক :
আসন্ন রোজায় বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার পাশাপাশি মজুদদারি বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পাশাপাশি নতুন সরকারের নির্বাচনি ইশতেহার বাস্তবায়ন এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ‘দক্ষ ও স্মার্ট প্রশাসন’ গড়ে তোলার লক্ষ্যে বিভিন্ন দিক নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি।

banner

আজ ৩ মার্চ রবিবার দুপুরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের শাপলা হলে ডিসি সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সরকার প্রধানের এসব নির্দেশনা আসে।

বাজার নিয়ন্ত্রণে মাঠ প্রশাসনকে উদ্যোগী হওয়ার তাগিদ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমাদের সব থেকে লক্ষ্য রাখতে হবে, আমাদের বাজার পরিস্থিতি কেমন। আর তাছাড়া সামনে রোজা আসছে, এই রমজান মাসে কিছু কিছু ব্যবসায়ী থাকে যারা মজুদদারি করে দাম বাড়িয়ে কিছু মুনাফা লুটতে চায়। সেই দিকে বিশেষভাবে নজর দিতে হবে।

“কারণ এটা আশু করণীয় একটা কাজ আমাদের। কোথাও যেন ভোক্তাদের কোনো হয়রানি হতে না হয়, সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। আমাদের উৎপাদন বাড়াতে হবে। পরনির্ভরশীলতা আমাদের কমাতে হবে এবং এটা যে আমরা পারি, এটা আমরা অনেক ক্ষেত্রে প্রমাণ করেছি। কাজেই সেদিকে নজর রাখা দরকার।”

শেখ হাসিনা বলেন, “সরবরাহের ক্ষেত্রেও কখনো শোনা যায়, কখনও সেটা নিয়ে নানা সমস্যা সৃষ্টি হয়, একটা কৃত্রিম সমস্যার সৃষ্টি করার চেষ্টা করা হয়। মজুদদারি করে পচিয়ে ফেলবে, কিন্তু বাজারে দেবে না। এরকম একটা অবস্থার সৃষ্টি হয়। সেই দিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি এবং কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার।

“রমজান মাস সামনে রেখেই আমি বললাম, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য যেন সাধারণ মানুষের কাছে যথাযথভাবে পৌঁছাতে পারে। সেই ব্যবস্থার দিকে সকলকে নজর দিতে হবে।”

খাদ্যে ভেজাল বন্ধে নজর রাখার নির্দেশ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “রোজা এলে এই সমস্যাগুলো বেশি দেখা যায়। খাদ্যে নানা রকম সমস্যা করে, এগুলোর ওপর নজর দিতে হবে।”

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার বিষয়ে দিক নির্দেশনা দিতে গিয়ে জেলা প্রশাসকদের সামনে ‘কিশোর গ্যাং’ নিয়েও কথা বলেন সরকারপ্রধান।

তিনি বলেন, “ইতোমধ্যে কয়েকটি সমস্যা আমরা দেখতে পাচ্ছি। কিশোর গ্যাং, যখন ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাবে পড়াশোনা করবে, সেই সময়ে এই কিশের গ্যাং। যখন করোনাভাইরাসের অতিমারী সব থেকে বেশি, সে সময়ে এটা সামনে এসেছে। প্রত্যেকটা এলাকাভিত্তিক যে ছেলেমেয়েরা, যারা শিক্ষাগ্রহণ করবে? তারা কেন এই ধরনের গ্যাং হবে? তারা কেন এই ধরনের অসামাজিক কাজে বা ছিনতাই খুন ডাকাতিতে লিপ্ত হবে? সে সমস্ত বিষয় নজরদারি করা একান্তভাবে অপরিহার্য।

“আমাদের কমিশনারবৃন্দ এবং জেলা প্রশাসকবৃন্দ, একেবারে উপজেলা পর্যন্ত, ইউনিয়ন পর্যন্ত স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছেৃ সেখানে ছেলেমেয়েরা কী কী কাজ করছে, জঙ্গিবাদ, মাদক অথবা এই কিশোর গ্যাংয়ের মধ্যে যুক্ত হচ্ছে কি না, সেদিকে একটু নজরদারি বাড়াতে হবে। আমার মনে হয়, পরিবারকে একটু সচেতন করতে পারলে, এই জিনিসগুলো কমবে।”

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “শুধু গ্রেপ্তার করে, ধরে লাভ নেই। কারণ গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠালে জেলেৃ অপরাধীদের সঙ্গে মিশে এরা আরও খারাপ হয়ে যায়। সে কারণে গোড়া থেকে আমাদের ধরতে হবে। পরিবার থেকেই শুরু করতে হবে। বিশেষ করে স্কুল কলেজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকেই শুরু করতে হবে। ছেলেমেয়েরা যেন এই পথে যেতে না পারে।”

পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকা যেন কোনোভাবে অস্থির না হয়, সে দিকেও নজর রাখতে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের তাগিদ দেন সরকারপ্রধান।

তিনি বলেন, “আমরা পার্বত্য চট্রগ্রামে শান্তি চুক্তি করেছি। আমরা কিন্তু অন্য কোনো দেশের সাহায়তা নিইনি। কারণ তারা আমার দেশের নাগরিক। আমি ৮১ সালে দেশে ফিরে আসার পর থেকে এ ব্যপারে যথেষ্ট সচেতন ছিলাম। আমাদের দলের পক্ষ থেকে আমরা একটা বিশেষ কমিটি করে দিয়েছিলাম। যার মাধ্যমে ওই অঞ্চলে কী সমস্যা, কেন এই অবস্থার সৃষ্টি হলে, কী কারণে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল ১৯৭৬ সালের পর থেকেৃ সেগুলো জেনে আমরা দীর্ঘ দিন কাজ করেছি।

“যারা বিক্ষুব্ধ ছিল, তাদের সঙ্গে আলোচনা করেছি এবং যখন ১৯৯৬ এ ক্ষমতায় এসেছি, তখন সংসদে কমিটি করেছি। পাশাপাশি আমি নিজেও এদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে আমরা একটা শান্তি চুক্তি করতে সক্ষম হয়েছি। শুধু শান্তি চুক্তি না, সেখানে যারা অস্ত্রধারী ছিল, ১৮০০ অস্ত্রধারী, প্রকাশ্যে আমার সামনে তারা অস্ত্র সারেন্ডার করেছে। পৃথিবীর বহু দেশে শান্তি চুক্তি হয়েছে, কিন্তু আমাদেরটা ছিল অনন্য ঘটনা।“

শেখ হাসিনা বলেন, “এ ধরনের ঘটনা কমই ঘটে যে অস্ত্র সারেন্ডার করে। পর্বত্য চট্টগ্রামে খুব উন্নয়নের কাজ চলছে। অর্থ সামাজিক উন্নয়ন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন সেগুলো আমরা করে যাচ্ছি। আমাদের এখানে বর্ডার লাইন ছিল না, সেখানে কোনো বর্ডার পোস্ট ছিলো না। আমরা নতুন করে সেখানে বর্ডার পোস্ট তৈরি করা শুরু করে দিয়েছি।

“পার্বত্য চট্টগ্রামে এখনও কিছু কিছু দুর্ঘটনা ঘটে। এই বিষয়েও সকলকে নজর দিতে হবে। সেখানে কোনো রকম যেন অশান্ত পরিবেশ অবার ফিরে না আসে। সেখানে শান্তি সৌহার্দ্যপূর্ণ অবস্থা যেন বিরাজমান হয়। এরা বিশেষ আইনে চলে, সেদিকে লক্ষ্য রেখেও তাদের সার্বিক বিবেচনায় দৃষ্টি দিতে হবে।”

সর্বজনীন পেনশন স্কিমে আসতে মানুষকে সচেতন করার জন্য ডিসিদের তাগিদ দেন সরকারপ্রধান। পাশাপাশি কৃষি উৎপাদন যেন বৃদ্ধি পায়, সে বিষয়ে নজর দিতে বলেন।

তিনি বলেন, “আমাদের এলাকাভিক্তিক কিছু উৎপাদিত পণ্য আছে। সেগুলোর ওপর গুরুত্ব দিয়ে উৎপাদন বাড়ানো এবং কোয়ালিটিটা দেখা, সেই বিষয়ে নজর দেওয়া দরকার।”

প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে মানুষের কতটুকু কাজে আসবে, সে বিষয়টি আগে বিবেচনায় নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘শুধু প্রকল্প প্রণয়ন এবং প্রকল্প বাস্তবায়নই নয়, সাধারণ মানুষ কতটুকু উপকৃত হবে? আর্থিকভাবে দেশ কতটুকু স্বচ্ছল হবে? সে অঞ্চলের মানুষের কতটুকু আর্থসামাজিক উন্নতি হবে? সেসব বিবেচনা করেই প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। শুধুমাত্র বড়সড় একটা টাকার অংক আর একটা প্রকল্প, সেই প্রকল্প কিন্তু আমি গ্রহণ করি না।”

গ্রামীণ অর্থনীতিকে যত বেশি শক্তিশালী করা যায়, গ্রামের মানুষের ক্রয় ক্ষমতা যেন বাড়ানো যায়, সেদিকে দৃষ্টি দিতে জেলা প্রশাসকদের প্রতি আহ্বান জানান শেখ হাসিনা।

শিশু-কিশোর ও যুবকদের খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করার তাগিদ দিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, “একবার যখন জঙ্গিবাদ সন্ত্রাস শুরু হল, আমাদের দেশে একটামাত্র ঘটনাই ঘটেছিল, সেটা খুব তাড়াতাড়ি সমাধান করতে পেরেছি। কিন্তু অনেকগুলো মানুষকে আমরা বাঁচাতে পারিনি।”

এরপর যে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত কমিটি করে অভিভাবকদের সচেতন করা শুরু হয়েছিল, সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “পাশাপাশি যুব সমাজকে ব্যস্ত রাখার জন্য বা শিশু কিশোরদের ব্যস্ত রাখার জন্য ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার বিভিন্ন কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত রাখতে হবে।”

উন্নয়নশীল দেশের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আগ থেকে প্রস্তুতি নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “জাতির পিতা যেখানে স্বল্পোন্নত দেশ রেখে গিয়েছিলেন, সেখান থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা নিয়ে যাত্রা শুরু করব ২০২৬ সালে। এখন থেকে সেই প্রস্তুতিটা নিতে হবে।”

প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্য শেষে ডিসি সম্মেলনের উদ্বোধন ঘোষণা করেন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন। পরে বক্তব্য দেন জনপ্রশাসনমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন।

মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, সিনিয়র সচিব ও সচিবরা, বিভাগীয় কমিশনাররা, জেলা প্রশাসকরা উপস্থিত ছিলেন সম্মেলনে।

সম্মেলনের বিভিন্ন কার্য-অধিবেশন হবে ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে। সরকারের নীতি-নির্ধারক ও জেলা প্রশাসকদের মধ্যে সামনাসামনি মতবিনিময় এবং প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য প্রতি বছর ডিসি সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।

ডুমুরিয়ায় ট্রাক-ইজিবাইক সংঘর্ষে নিহত ৫

জাতীয়, 10 February 2024, 877 Views,

অনলাইন ডেস্ক :
খুলনার ডুমুরিয়ায় ট্রাক ও ব্যাটারিচালিত ইজিবাইকে সংঘর্ষে পাঁচজন নিহত হয়েছেন। দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন আরো তিনজন।

banner

আজ ১০ ফেব্রুয়ারি শনিবার বিকালে উপজেলার খর্ণিয়া ইউনিয়নের আঙ্গারদোহা গ্রামে এ দুর্ঘটনা ঘটে।

নিহতরা হলেন- খর্নিয়া ইউনিয়নের আঙ্গারদোহা গ্রামের সাব্বির মোড়ল (২৩), শোভনা ইউনিয়নের জিয়েলতলা গ্রামের ইজিবাইকচালক বিশ্বজিৎ বিশ্বাস (৩০) ও তার শিশুপুত্র অর্ণি বিশ্বাস (৪), গুটুদিয়া ইউনিয়নের বিলপাবলা গ্রামের নিপা ঢালী (২৫) ও তার শাশুড়ি অমরি ঢালাী (৫৫)।

আহতরা হলেন- অন্তিমা বিশ্বাস (২৬) ও অরজিৎ ঢালী(৬)। অন্যজনের পরিচয় জানা যায়নি। তাদের খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। হতাহতরা সবাই ইজিবাইকের যাত্রী।

ডুমুরিয়া থানার ওসি সুকান্ত সাহা দুর্ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, সাতক্ষীরা অভিমুখী ট্রাকের সঙ্গে খুলনা অভিমুখী ইজিবাইকের সংঘর্ষ হলে ঘটনাস্থলে দুজন এবং হাসপাতালে নেওয়ার পর আরও তিনজনের মৃত্যু হয়। দুর্ঘটনা কবলিত ট্রাক ও ইজিবাইক জব্দ করা হয়েছে। তবে চালক ও হেল্পার পালিয়ে গেছে।

চোরাই মোটরসাইকেলসহ গ্রেফতার ২

জাতীয়, 11 October 2023, 992 Views,

চলারপথে রিপোর্ট :
এক থেকে দুই মিনিট। এর মধ্যে তালা ভেঙে একটি মোটরসাইকেল চুরি করতো। সেটিকে গ্যারেজে এনে ইঞ্জিন-চেচিস নম্বর ১০ মিনিটে পরিবর্তন করতো। পরিবর্তন করতো রঙও। তারপর ক্রেতার কাছে সেকেন্ড হ্যান্ড বলে বিক্রি করতো। কখনো কখনো মোটর সাইকেলের যন্ত্রাংশ আলাদা করে বিক্রি করতো। এমন একটি চক্রকে আটক করেছে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম পুলিশ। একটি মোটর সাইকেল চুরির সূত্র ধরে এই সাতটি মোটরসাইকেলসহ দুজনকে গ্রেফতার করেছে চৌদ্দগ্রাম থানা পুলিশের একটি দল। এ সময় পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে আরো দুই চোর পালিয়ে যায়।

banner

গ্রেফতারকৃতরা হলো- চৌদ্দগ্রাম উপজেলার কুলাসার গ্রামের মো. সাদ্দাম হোসেন (৩২) ও বিষ্ণপুর গ্রামের মো. ফরহাদ হোসাইন (২৬)। পলাতক আসামিরা হলেন বিষ্ণপুর গ্রামের মো. সোহেল (৩০) ও ঝিকড্ডা গ্রামের শাহ আলম (৩২)।

আজ বুধবার নিজ কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে কুমিল্লা জেলা পুলিশ সুপার আবদুল মান্নান এসব তথ্য নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, ৯ অক্টোবর চৌদ্দগ্রাম থানায় মোটরসাইকেল চুরির একটি অভিযোগ পেয়ে ফেনী জেলার সীমান্তবর্তী লাটিমি রাস্তার মাথা থেকে সাদ্দামকে গ্রেফতার করে। তার দেয়া তথ্যমতে ১০ অক্টোবর রাতে চৌদ্দগ্রাম উপজেলার ঝিকড্ডা গ্রামের শাহ আলমের গ্যারেজে অভিযান চালায় পুলিশ। এ সময় শাহ আলম ও সোহেল পালিয়ে যায়। সাদ্দাম ও ফরহাদকে গ্রেফতার করা হয়।

গ্রেফতারকৃত ও পলাতক আসামিরা দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন এলাকা থেকে মোটর সাইকেল চুরি করে একটি গ্যারেজে রাখতেন। সেখান থেকে ইঞ্জিন ও চেচিস নম্বর পরিবর্তন করে বিক্রি করতেন। যারা পালিয়েছে তাদেরকে গ্রেফতার করতে পারলে আরো অনেক চোরাই মোটরসাইকেল উদ্ধার হতে পারে।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিবি) নাজমুল হাসান, চৌদ্দগ্রাম সার্কেলের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার জাহিদুল ইসলাম ও চৌদ্দগ্রামের ওসি ত্রিনাথ সাহা তন্ময়।

গোপালগঞ্জ-৩ আসনে নির্বাচন করবেন শেখ হাসিনা

জাতীয়, 26 November 2023, 941 Views,
ফাইল ছবি

অনলাইন ডেস্ক :
গোপালগঞ্জ-৩ আসন থেকে নির্বাচন করবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

banner

আজ ২৬ নভেম্বর রবিবার বিকেলে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ২৯৮ আসনে প্রার্থী তালিকা ঘোষণার সময় এ কথা জানান।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন- আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান কাজী জাফরউল্যাহ, কামরুল ইসলাম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ, ড. হাছান মাহমুদ; সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক আব্দুস সবুর, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আব্দুস সোবহান গোলাপ, দফতর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া প্রমুখ।
এর আগে, সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের সভায় প্রার্থী নির্ধারণ করে আওয়ামী লীগ।

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সারাদেশের ৩০০টি সংসদীয় আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হতে মনোনয়ন ফরম কেনেন ৩ হাজার ৩৬২ জন।

তফসিল অনুযায়ী আগামী ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ হবে। ৩০ নভেম্বরের মধ্যে মনোনীত প্রার্থীদের নির্বাচন কমিশনে মনোনয়ন ফরম জমা দিতে হবে।

ঢালাও আসামির নেপথ্যে বাণিজ্য, বিদ্বেষ, দ্বন্দ্ব

জাতীয়, 27 April 2025, 268 Views,

অনলাইন ডেস্ক :
কিশোরগঞ্জের দুলাল রবিদাসের মৃত্যু হয়েছে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের (স্ট্রোক) কারণে। গত বছরের ২৭ জুলাই তাঁর মৃত্যুর কারণ উল্লেখ করে সনদ দিয়েছে স্থানীয় একটি হাসপাতাল। অথচ জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে তিনি নিহত হয়েছেন—এমন অভিযোগ এনে ২৯ নভেম্বর কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানায় হত্যা মামলা করা হয়েছে। আসামি করা হয় অজ্ঞাতনামা ৬০০ জনসহ ৭৬৮ জনকে।

banner

এ মামলা নিয়ে প্রথম আলোর অনুসন্ধানে চাঁদাবাজি ও পূর্বশত্রুতার জেরে হয়রানির অভিযোগসহ নানা অনিয়ম সামনে এসেছে। যে অভিযোগে মামলাটি হয়েছে, তা সঠিক নয় বলে দাবি করেছেন দুলাল রবিদাসের স্বজনেরাই। ঘটনার সময়, হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা, আসামির তালিকা—সবই ভুয়া।

গত বছর ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের বিভিন্ন থানায় জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মামলা হয়েছে। আহত হওয়ার ঘটনায়ও অনেক মামলা হয়েছে। এসব মামলায় প্রকৃত আসামি, সন্দিগ্ধ ব্যক্তির পাশাপাশি হয়রানিমূলকভাবেও অনেককে আসামি করা হয়েছে। যাঁদের মধ্যে ব্যবসায়ী, পেশাজীবী, অন্যত্র থাকা মানুষ ও অরাজনৈতিক ব্যক্তিও রয়েছেন। দুলাল রবিদাসের মতো সাজানো ঘটনার পাশাপাশি কোথাও সত্য ঘটনার মামলায় এ রকম অনেককে আসামি করে ‘মামলা–বাণিজ্য’ হচ্ছে। মামলা থেকে নাম বাদ দেওয়ার আশ্বাস, ভুলবশত আসামি করা হয়েছে মর্মে হলফনামা দিয়ে ও পুলিশ প্রতিবেদনে নির্দোষ দেখানোর প্রতিশ্রুতিসহ নানাভাবে এই বাণিজ্য করার অভিযোগ যেমন আছে, আবার প্রতিপক্ষের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়েও কাউকে কাউকে মামলায় ফাঁসানোর অভিযোগও রয়েছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, জুলাই অভ্যুত্থানে হতাহতসহ বিভিন্ন ঘটনায় অন্তত ১ হাজার ৪৯৯টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে হত্যা মামলা ৫৯৯টি। অন্যান্য ৯০০টি। এসব মামলায় ১০ হাজারের বেশি ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। হত্যা মামলার মধ্যে অনেকগুলোর তদন্তে অগ্রগতি আছে বলেও পুলিশ সূত্র জানিয়েছে।

তবে দুলাল রবিদাসের মৃত্যুর ঘটনায় করা মামলাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার ৪০টি মামলা পর্যালোচনা করে ঢালাওভাবে আসামি করাসহ নানা অসংগতি দেখা গেছে। ঘটনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ব্যক্তিদের চেয়ে উদ্দেশ্যমূলকভাবে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে।

মাঠপর্যায়ে খোঁজখবর করে জানা গেছে, হয়রানিমূলক আসামি করার ক্ষেত্রে অধিকাংশ স্থানে ভূমিকা রেখেছেন বিএনপির কোনো না কোনো নেতা–কর্মী। কিছু ক্ষেত্রে কতিপয় অসাধু আইনজীবী, পুলিশ সদস্য ও দালাল চক্র জড়িত। কোথাও প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোর জন্য, কোথাও চাঁদাবাজির জন্য, কোথাও ব্যক্তিগত বা পারিবারিক দ্বন্দ্বের কারণে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আসামি করার ঘটনা ঘটেছে। এমনকি জুলাই আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন অথবা বিএনপির রাজনীতিতে সম্পৃক্ত—এমন ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেও মামলা হয়েছে।

 

বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) অবৈতনিক নির্বাহী পরিচালক সারা হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ব্যক্তিগত বিরোধ ও বিদ্বেষ থেকে মামলায় বিভিন্নজনের নাম দেওয়া হচ্ছে। নিরপরাধ ব্যক্তিদের প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ থাকতে হবে।

মামলা কারা করছেন
যে ৪০টি মামলার খোঁজখবর নিয়েছে প্রথম আলো, সেগুলোর মধ্যে ২৩টি ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন থানায় ও ৯টি চট্টগ্রামে করা মামলা। বাকি ৮টি মামলার মধ্যে ৬টি নারায়ণগঞ্জের, কিশোরগঞ্জ ও ফেনীর ২টি মামলা। এসব মামলার বাদীদের মধ্যে ১৪ জন বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। দুজন শহীদের বাবা। একটি মামলার বাদী নিজেকে গণ অধিকার পরিষদের সদস্য হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। একটি মামলার বাদী যুবলীগ কর্মী, যিনি অন্য মামলার আসামি। বাকি ২২টি মামলার বাদীদের মধ্যে ৯ জন তাঁদের রাজনৈতিক পরিচয় জানাতে চাননি। ১৩ মামলার বাদীর রাজনৈতিক বা পেশাগত পরিচয় জানা যায়নি।

মামলাগুলোর তথ্য অনুসন্ধান করতে গিয়ে বাদী, আসামি ও তাঁদের স্বজন, সংশ্লিষ্ট থানা–পুলিশসহ বিভিন্ন পর্যায়ের শতাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। ২১টি মামলা হওয়ার আগে-পরে কোনো কোনো আসামির কাছ থেকে অর্থ দাবি ও অর্থ লেনদেনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। বাকি ১৯ মামলায় রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক, পেশাগত ও পারিবারিক দ্বন্দ্ব থেকে অনেককে আসামি করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী ব্যক্তি ও তাঁদের স্বজনেরা। অনেক আসামিকে বাদী চেনেনও না।

পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, ৫ আগস্ট–পরবর্তী সময়ে পুলিশ সদস্যদের মনোবল দুর্বল ছিল। তখন যাচাই-বাছাই করে মামলা নেওয়ার মতো পরিস্থিতি থানাগুলোর ছিল না। অনেক ক্ষেত্রে আদালতের নির্দেশেও মামলা হয়েছে।

ঢালাও আসামি করার বিষয়টি এমন পর্যায়ে গেল যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি পর্যন্ত জারি করতে হয়েছে। গত ১৪ অক্টোবর জারি করা ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, চাঁদাবাজি, ব্ল‍্যাকমেল করাসহ নানা রকম হয়রানি করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ব্যক্তির বিরুদ্ধে হত্যাসহ বিভিন্ন ধরনের মিথ্যা মামলা দেওয়া হচ্ছে। এ ধরনের উদ্দেশ্যমূলক মামলা দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী ফৌজদারি অপরাধ। এ ধরনের মামলা করার মাধ্যমে যাঁরা অপতৎপরতা চালাচ্ছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এ ছাড়া হয়রানিমূলকভাবে যাঁদের আসামি করা হয়েছে, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে না বলে সরকারের উচ্চপর্যায় ও পুলিশের পক্ষ থেকে বারবার বলা হয়েছে।

তবে গ্রেপ্তার থেমে থাকেনি। ব্যবসায়িক বা সম্পত্তিগত বিরোধের জেরে আসামি হওয়া ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারের জন্য প্রতিপক্ষ যেমন সক্রিয় থাকে, পাশাপাশি ‘বাণিজ্যের’ উদ্দেশ্যে করা আসামিদের ধরতে কিছু ক্ষেত্রে পুলিশের বেশি আগ্রহ দেখা গেছে। আবার কিছু ক্ষেত্রে আদালত থেকে জামিন পাওয়ার পর ‘শ্যোন অ্যারেস্ট’ বা নতুন মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর হুমকি দিয়েও অর্থ আদায়ের অভিযোগ আছে। শুরুতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে মামলা না করে খসড়া এজাহারে দেখিয়ে অনেকের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের অভিযোগও আছে।

এদিকে আন্দোলনের সময় ছাত্র–জনতার ওপর সরাসরি হামলায় যাঁরা ছিলেন, তাঁদের বড় অংশ এখনো ধরা পড়েনি। শহীদদের স্বজনেরা প্রিয়জন হত্যার বিচারের দাবি জানিয়ে আসছেন। তবে মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রায় প্রতিটি মামলায় এত বেশিসংখ্যক মানুষকে আসামি করা হয়েছে, তাঁদের সবার বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ করতেই তাঁরা হিমশিম খাচ্ছেন।

এ বিষয়ে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলমের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সারা দেশে ১০টি মেন্টরিং অ্যান্ড মনিটরিং দলের মাধ্যমে মামলাগুলো তদারক করা হচ্ছে। এর মধ্যে আট বিভাগে ৮টি, রাজধানীতে ১টি ও গাজীপুরের জন্য ১টি দল করা হয়েছে। প্রতিটি দল নিয়ে আমি বসছি এবং মামলাগুলো বিশ্লেষণ করছি। এতে নিরপরাধ ব্যক্তিদের হয়রানি করার ঘটনা কমে এসেছে।’

আইজিপি বলেন, ‘আসামি যতই হোক, অপরাধের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেই অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।’
এক মামলায় যত অসংগতি

কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীর বাসিন্দা বাবুল মিয়া (২৮) ও সাইফুল ইসলাম (৪০)। বাবুল কৃষিকাজ ও পশুপালন করেন। তাঁর বোনের স্বামী সাইফুল ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। এ দুজনকে দুলাল হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে। গ্রেপ্তার–আতঙ্কে তাঁরা বাড়িছাড়া।

বাবুল মিয়ার বাবা বকুল মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, জমি নিয়ে বিরোধের জেরে তাঁর ছেলে ও জামাতাকে মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। তাঁরা কোনো দিন রাজনীতি করেননি। প্রথম মামলার পর তাঁদের বলা হয়েছে, ৫০-৬০ হাজার টাকা দিলে আসামির তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়া হবে। টাকা দিতে না পারায় আরও তিনটি মামলায় তাঁদের আসামি করা হয়েছে।

দুলাল হত্যা মামলাটি করেছেন রাফিউল আলম নামের এক ব্যক্তি। তিনি নিজেকে গণ অধিকার পরিষদের নেতা পরিচয় দিলেও কী পদে ছিলেন, তা বলতে পারেননি। মামলায় অভিযোগ করা হয়, গত বছরের ১৮ জুলাই দুপুরে কিশোরগঞ্জের গৌরাঙ্গবাজার মোড় এলাকায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের গুলিতে গুরুতর আহত হন দুলাল। পরে ২২-২৩ জন তাঁকে রড দিয়ে বেদম পিটুনি দেন। হাসপাতালে নেওয়ার পথে তাঁর মৃত্যু হয়।

এ রকম একটা মামলার কথা জানার পর প্রয়াত দুলালের ছেলে বিকাশ দাশ কিশোরগঞ্জের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে লিখিতভাবে জানান যে তাঁর বাবার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় হত্যা মামলা করে যাঁরা নিরপরাধ মানুষদের হয়রানি করছেন, তাঁদের শাস্তির দাবি করেন বিকাশ।

হত্যাকাণ্ডের যে স্থানের কথা বলা হচ্ছে, সেখানে ঘটনার দিন (১৮ জুলাই) দুলাল ছিলেন না বলে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন তাঁর ছোট ভাই কাঞ্চন রবিদাস। মৃত্যুনিবন্ধন সনদে দুলালের মৃত্যুর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে ‘স্ট্রোক’ এবং মৃত্যুর তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে ২৭ জুলাই।

আসামিদের অভিযোগ যাচাই করতে এক ব্যক্তিকে বাবুল ও সাইফুলের স্বজন পরিচয় দিয়ে বাদী রাফিউলের সঙ্গে কথা বলিয়েছে প্রথম আলো। ওই ব্যক্তির কাছে রাফিউল মামলা থেকে নাম বাদ দিতে মাথাপিছু ৫০ হাজার টাকা দাবি করেন। এ টাকার ভাগ স্থানীয় এক আইনজীবী ও পুলিশকে দেবেন বলেও দাবি করেন তিনি। এ মামলার আরও চার আসামি প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, নাম বাদ দিতে তাঁদের কাছ থেকেও ৫০-৬০ হাজার টাকা করে দাবি করা হয়েছে।

এসব অভিযোগ অস্বীকার করে রাফিউল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা রবিদাসকে হত্যা করতে দেখেছি। অনেকে মিলে মামলাটি করেছি। এ জন্য ভুলে অনেকের নাম ঢুকে গেছে।’

এ মামলার ভুক্তভোগীরা গত ৪ জানুয়ারি কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জে মানববন্ধন করেন। সেখানে তাঁরা অভিযাগ করেন, স্থানীয় ‘আওয়ামী আইনজীবী’ শওকত কবীর খোকন এ মামলা-বাণিজ্যে জড়িত। এলাকার বিএনপির নেতা-কর্মীদেরও মামলায় ফাঁসিয়েছেন তিনি।

শওকত কবীর প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, তিনি ‘বিএনপির সৈনিক’। সুনাম নষ্ট করতে প্রতিপক্ষ তাঁর বিরুদ্ধে মামলা-বাণিজ্যে জড়িত থাকার অপপ্রচার চালাচ্ছে।

আসামি চেনেন না বাদী
যে ৪০টি মামলা নিয়ে প্রথম আলো অনুসন্ধান করেছে, সেগুলোর এজাহারে উল্লেখ করা ১১ বাদীর মুঠোফোন নম্বরে কল করে সেগুলো বন্ধ পাওয়া গেছে। কেউ কেউ ঠিকানা পরিবর্তন করেছেন অথবা ভুয়া ঠিকানা দিয়েছেন। ফলে আসামি ও তাঁদের স্বজনেরা বাদীকে খুঁজে পাচ্ছে না। ১৪ জন বাদী জানিয়েছেন, অন্য কেউ তাঁদের দিয়ে মামলা করিয়েছেন। এর মধ্যে চারজন জানিয়েছেন, মামলার কাগজে তাঁদের কাছ থেকে কেবল সই নেওয়া হয়েছে। আসামির নাম দিয়েছেন অন্যরা।
লক্ষ্য অর্থ আদায়

অভ্যুত্থান ঘিরে হওয়া প্রথম দিকের মামলাগুলোর আসামিদের বেশির ভাগই ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের ও আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তাঁদের পাশাপাশি অনেক মামলায় উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আরও অনেককে আসামি করা হয়।

গত বছর সেপ্টেম্বরের শুরুতে রাজধানীর একটি থানায় একটি হত্যা মামলা হয়। সেখানে ১০ জনের বেশি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে আসামি করা হয়। তাঁদের প্রায় সবাই ঘটনার সময় মামলায় উল্লেখিত স্থানে ছিলেন না বলে পুলিশের নথিতেই উল্লেখ রয়েছে।

 

এ বিষয়ে মামলার আসামি পুলিশের এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, বাদী ১০ জনের নাম এজাহার থেকে বাদ দিতে ১ কোটি টাকা দাবি করেছিলেন। টাকা না দেওয়ায় তাঁদেরও আসামি করা হয়।

পরে ওই বাদীর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আসামিদের তিনি চেনেন না, তা সঠিক। তবে কোনো টাকা চাননি বলে দাবি করেন তিনি।

অবৈধ সুবিধা আদায়ে ব্যবসায়ীদের আসামি করার দুটি হত্যা মামলা হয়েছে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার থানায়। এসব মামলার সঙ্গে যুবদল ও বিএনপির নেতাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। মামলা দুটির এজাহারের বর্ণনা প্রায় একই রকম। সেখানে বৃহৎ রপ্তানিমুখী পোশাক প্রস্তুতকারী একটি প্রতিষ্ঠানের তিন মালিককে আসামি করা হয়েছে।

এজাহার থেকে নাম বাদ দেওয়ার আশ্বাস কিংবা আসামির তালিকা থেকে নাম প্রত্যাহারের আবেদনের জন্য টাকা নেওয়ার পাঁচটি ঘটনার কথা জানা গেছে। রাজধানীর এক ব্যবসায়ীর নাম বাদ দিতে বাদী আবেদন করেছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই ব্যবসায়ী প্রথম আলোকে বলেন, ‘যে মামলায় আমাকে ফাঁসানো হয়েছে, আমি তার ধারেকাছেও ছিলাম না। পরে বাদীর সঙ্গে যোগাযোগ করে এক লাখ টাকা দিলে তিনি এজাহার থেকে নাম বাদ দিতে আবেদন করিয়েছেন।’

জুলাই আন্দোলনের সময় রাজধানীর একটি অঞ্চলে অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) ছিলেন এক পুলিশ কর্মকর্তা। বর্তমানে ঢাকার বাইরে কর্মরত ওই কর্মকর্তার মুঠোফোনে বার্তা পাঠান রাজধানীর ওয়ার্ড পর্যায়ের বিএনপির একজন নেতা। তাতে বলা হয়, মামলা থেকে ‘বাঁচতে হলে’ পাঁচ লাখ টাকা দিতে হবে। পুলিশের ওই কর্মকর্তা ১ জানুয়ারি এই প্রতিবেদককে ওই বার্তা দেখান। পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওই ব্যক্তি বিএনপির একজন নেতা। দুই লাখ টাকা দেওয়ার পর তিনি ওই পুলিশ কর্মকর্তার নাম বাদ দিতে সম্মত হন।

‘সচেতন নাগরিক’ পরিচয়ে মামলা
অনেক ক্ষেত্রে পরিবারের পরিবর্তে ‘সচেতন নাগরিক’ পরিচয়ে অন্য ব্যক্তিরা মামলার বাদী হয়েছেন। এ রকম একটি ক্ষেত্রে দেখা গেছে, একই ঘটনায় দুটি মামলা হয়েছে এবং আরও একটির আবেদন করা হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ফখরুল ইসলামকে মিরপুর থানার তিনটি হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে। বর্তমানে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ফখরুলকে এজাহারে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা উল্লেখ করা হয়েছে। এসব মামলায় তাঁর দুই ভাইকেও আসামি করা হয়। দুটি মামলায় ঘটনা শুক্রবার দেখানো হয়েছে।

এ মামলার দুই আসামি অভিযোগ করেন, সাপ্তাহিক ছুটির দিনকে (শুক্রবার) মামলার সময় হিসেবে দেখানোর পেছনের মূল উদ্দেশ্য তাঁদের মতো চাকরিজীবী ব্যক্তিদের হরয়ানি করা।

মামলা তিনটি (মো. সেলিম আলী সেক (৩৬), পারভেজ হোসেন (২১) ও মো. মনিরুল ইসলাম (৪১) হত্যা) স্বজনদের কেউ করেননি। ‘সচেতন নাগরিক’ পরিচয়ে মামলাগুলো করেছেন তিন ব্যক্তি। তিন মামলার এজাহারের বর্ণনা অনেকটা একই রকম।

এজাহারে থাকা বাদীদের মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগ করে পারভেজ হত্যার বাদী নুরু ইসলামকে (৪০) ফোনে পাওয়া যায়। তবে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।

৫ আগস্ট ঢাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়া কিশোর মাহমুদুল হাসানের বাবা রিকশাচালক মিজানুর রহমান মামলা করতে পারেননি। ১২ সেপ্টেম্বর ঢাকার আদালতে মামলা করতে গিয়েছিলেন তিনি। পরে জানতে পারেন, এ ঘটনায় আগেই যাত্রাবাড়ী ও ডেমরা থানায় দুটি মামলা হয়েছে। দুটি মামলায় মাহমুদুলের নিহত হওয়ার পৃথক স্থান উল্লেখ করা হয়েছে। ওই দুই বাদীকে চেনেন না মিজানুর রহমান। তিনি আক্ষেপ করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছেলেকে আন্দোলনে গুলি করে হত্যা করা হয়, কিন্তু আমি মামলা করতে পারলাম না!’
প্রতিষ্ঠানের দখল নিতে আসামি

রাজধানীর মিরপুরে রেস্তোরাঁ ব্যবসা রয়েছে আমিনা বেগমের। তাঁর ব্যবসায়িক অংশীদার ভাষানটেক থানা যুবদলের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক পরিচয় দেওয়া রবিউল ইসলাম (সুমন)। রেস্তোরাঁ পরিচালনা নিয়ে দুজনের মধ্যে দ্বন্দ্ব রয়েছে। একটি মুঠোফোনে কথোপকথনে রবিউলকে বলতে শোনা যায়, ‘মহিলার (আমিনা) নামে দিয়ে দিছি মামলা। ও এখন বুঝুক। বেশি তালবেতাল করলে ওর স্বামীর নামেও দিমু, ওর চাকরিও খামু।’

আমিনাসহ ৩৪৬ জনের নামে ভাষানটেক থানায় মামলাটি করেছেন মো. মোস্তাকিম নামের এক ব্যক্তি। মামলার নথিতে মোস্তাকিম নিজেকে আন্দোলনে আহত এবং গুলিতে ডান পা হারানো ব্যক্তি উল্লেখ করেছেন। একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করে তাঁর মুঠোফোন নম্বর বন্ধ পাওয়া গেছে।

 

মামলায় ৩১ নম্বর আমিনার পরিচয় দেওয়া হয়েছে ঢাকা মহানগর উত্তর মহিলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। তবে কমিটির তালিকায় তাঁর নাম নেই। আমিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি গত ১৯ জুলাই কাফরুলে দেশি অস্ত্র বা লোহার রড অথবা লাঠিসোঁটা দিয়ে বাদীর মাথায় আঘাত করেছেন।

স্বামীর সরকারি চাকরির সুবাধে আমিনা থাকেন কুমিল্লায়। সিসিটিভির একটি ফুটেজে দেখা গেছে, মামলায় যে দিনক্ষণ উল্লেখ করা হয়েছে, আমিনা সে সময় কুমিল্লায় ছিলেন। ভুক্তভোগী এই নারী প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রেস্তোরাঁ দখলে নিয়েছেন ওই যুবদল নেতা। তাঁকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়েছেন।

এ ঘটনায় আমিনার স্বামী মিরপুর মডেল থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন। ৫ জানুয়ারি ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারকে এ বিষয়ে লিখিতভাবে জানিয়েছেন আমিনা।

যুবদল নেতা রবিউল প্রথম আলোকে বলেন, ‘একটি নয়, আমিনার নামে তিনটি মামলা হয়েছে। তিনি রাজনীতি করেন, রাজনৈতিক মামলা খাবেন, এটাই স্বাভাবিক। নির্দোষ হলে আদালতে প্রমাণ করুক।’

মামলার বাদী মোস্তাকিম যুবদল করেন বলে জানান রবিউল। তিনি মুঠোফোনে কথোপকথনের বিষয়ে বলেন, ‘তিনি (আমিনা) যখন ক্ষমতা দেখিয়েছেন, তখন বলেছি আমার দল ক্ষমতায় আসলে আপনার চাকরি থাকবে না।’
নেপথ্যে পারিবারিক বিরোধ

ঢাকায় ব্যবসা করেন নাটোরের সিংড়ার এনায়েত করিম। ছাত্রজীবনে জিয়া ছাত্র পরিষদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক ছিলেন। পরে বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত হন। জুলাই অভ্যুত্থানের ঘটনায় রাজধানীর সূত্রাপুর ও বনানী থানার দুটি হত্যা মামলায় তাঁকে আসামি করা হয়েছে। পরিচয়ে লেখা হয়েছে আওয়ামী লীগ নেতা। গ্রামের বাড়িতে গেলে গত ২৮ ডিসেম্বর সিংড়া থানা–লিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে।

মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে ৩০ ডিসেম্বর নাটোরে সংবাদ সম্মেলন করেন এনায়েতের স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবারের সদস্যরা। সেখানে দাবি করা হয়, এনায়েতের ভাতিজা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফয়সাল আহম্মেদ এ মামলা করিয়েছেন।

পরে এনায়েতের স্ত্রী উম্মে সালমা প্রথম আলোকে বলেন, জমিসংক্রান্ত বিরোধ থেকে ফয়সাল মামলায় এনায়েতের নাম দিয়েছেন। পরিবারের সদস্যদের কাছে তা তিনি স্বীকারও করেছেন।

অবশ্য ফয়সাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘পারিবারিক দ্বন্দ্ব আছে সেটা ঠিক, তবে আমি মামলার বিষয়ে কিছুই জানি না। আমার চাচা এত দিন আওয়ামী লীগের সঙ্গে লিয়াজোঁ করে চলেছেন। সেখান থেকে অন্য কেউ হয়তো মামলা করে থাকতে পারেন।’
পেশাজীবী শ্রেণি ধরে মামলা

মামলার ধরন বিশ্লেষণে দেখা যায়, একেক মামলায় একেক শ্রেণির ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। কোথাও সাংস্কৃতিক কর্মী, কোথাও ব্যবসায়ী, কোথাও সাংবাদিক, কোথাও আবার পুলিশ, কোথাও আমলা। অর্থাৎ নির্দিষ্ট শ্রেণি–পেশার মানুষের নাম কেউ দিচ্ছে, সেগুলো ধরে মামলা হচ্ছে।

যেমন শাহবাগ থানার একটি মামলায় পুলিশের অন্তত ১০ জন কর্মকর্তাকে আসামি করা হয়েছে। মামলায় ঘটনার যে তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে, ওই দিন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা চাকরির সুবাদে খুলনায় ছিলেন। তাঁকেও আসামি করা হয়েছে।

গত ২৯ অক্টোবর ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে করা একটি মামলায় ৫৩ জন সচিবকে আসামি করা হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নির্বিচার গুলি চালিয়ে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে মামলাটি করা হয়। ছাত্রদলের সাবেক নেতা মোহাম্মদ জামান হোসেন খানের করা মামলাটি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) তদন্ত করছে। মামলার আসামি একজন সাবেক সচিব প্রথম আলোকে বলেন, মামলা নিয়ে বিভিন্নভাবে তাঁর কাছ থেকে অর্থ দাবি করা হয়েছিল।

ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক এক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মতিঝিল থানায় একটি মামলা হয়েছে। ওই মামলায় যতজনকে আসামি করা হয়েছে, তাঁদের নাম উল্লেখ করে পরে আদালতে আরেকটি মামলা করা হয়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দুটি মামলার নেপথ্যে আছেন বিএনপির এক নেতা।

ঢাকার যাত্রাবাড়ী থানার একটি হত্যা মামলায় বাংলাদেশ অ্যাগ্রো প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশনের (বাপা) সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ কমিটির ৯ জনকে আসামি করা হয়েছে, যাঁরা দেশের বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ী। মাহাদী হাসান হত্যার ঘটনায় করা এই মামলার বাদী নিজেকে নিহত ব্যক্তির চাচা দাবি করেছেন। অপর দিকে একই ঘটনায় মাহাদীর বাবা বাদী হয়ে কদমতলী থানায়ও একটি মামলা করেছেন। তাঁর দাবি, তাঁর ছেলে যাত্রাবাড়ী নয়, কদমতলী থানা এলাকায় শহীদ হয়েছেন।

শহীদ পরিবারের নামেও মামলা

অভ্যুত্থানে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইকরামুল হক সাজিদ। এ ঘটনায় করা মামলায় আসামি করা হয়েছে আন্দোলনের সময় চট্টগ্রামে শহীদ তানভীর সিদ্দিকীর পরিবারের তিন সদস্যকে। তাঁরা যুবদল-ছাত্রদলের সাবেক ও বর্তমান পদধারী নেতা। তাঁদের বাড়ি কক্সবাজারে।

৭ সেপ্টেম্বর কাফরুল থানায় মামলাটি করেন ইকরামুলের বাবা মো. জিয়াউল হক। পরে ৯ সেপ্টেম্বর ভুক্তভোগী ওই তিনজন ডিএমপি কমিশনারের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। সেখানে বলা হয়, আওয়ামী লীগের আমলে দলটির নেতা-কর্মীদের হামলায় কক্সবাজারের মহেশখালীর এই পরিবারের পাঁচজন নিহত হয়েছেন। আহত হন বেশ কয়েকজন। মিথ্যা মামলার শিকার হয়ে অনেকে বাড়িছাড়া ছিলেন। আন্দোলনের পুরো সময় তাঁরা কক্সবাজারে থেকেও ঢাকার মামলায় আসামি হয়েছেন।

মহেশখালী উপজেলা ছাত্রদলের সাবেক সহসভাপতি এবং তানভীর সিদ্দিকীর চাচাতো ভাই (৫৪ নম্বর আসামি) মিজানুর রহমান মাতাব্বর প্রথম আলোকে বলেন, ‘মামলার বাদী কখনো আমাদের দেখেনওনি, চেনেনও না, নামও শোনেননি। আমাদের নামগুলো লিখে তাঁর থেকে শুধু স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে। মামলার যে তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে, তখন আমরা মহেশখালী, কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছিলাম।’ মিজানুরের অভিযোগ, রাজনৈতিক বিরোধ থেকে তাঁদের ঢাকার এই মামলায় আসামি করিয়েছেন মহেশখালী উপজেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা।

মামলার বাদী জিয়াউল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি তো আর ঘটনাস্থলে ছিলাম না। ভার্সিটির ছাত্র-শিক্ষক এবং যাঁরা এই ঘটনা দেখেছেন, তাঁরা যে নামগুলো দিয়েছেন, সেগুলোই মামলায় আসামি হিসেবে এসেছে।’
নিরপরাধ ব্যক্তিদের কী হবে

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘটনায় করা বেশ কিছু মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে বলে জানা গেছে। হয়রানিমূলকভাবে আসামি হওয়া অনেক ব্যক্তিও গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। অথচ ছাত্র-জনতার ওপর সরাসরি গুলি করা ব্যক্তি এবং গুলির নির্দেশদাতাদের বড় অংশ ধরা পড়েননি। এ অবস্থায় প্রকৃত অপরাধীদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনার জোরালো দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগীসহ বিশেষজ্ঞরা। যথাযথভাবে যাচাই–বাছাই না করে কাউকে গ্রেপ্তার করা হবে না, সরকারের এমন কথার বাস্তবায়ন দেখতে চান তাঁরা।

সাবেক আইজিপি মুহাম্মদ নুরুল হুদা প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনা সত্য, কিন্তু আসামি ভুলভাবে বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে দেওয়া হয়েছে—এমন মামলা হয়েছে। এ জন্য মামলা গ্রহণের ক্ষেত্রে পুলিশকে সতর্ক হওয়া দরকার ছিল। তবে আদালতের নির্দেশেও থানাকে অনেক মামলা নিতে হয়েছে।

নুরুল হুদা বলেন, যাচাই–বাছাই করে আসামি গ্রেপ্তার করতে হবে। নিরপরাধ ব্যক্তিদের হয়রানি করা যাবে না। পাশাপাশি ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী মিথ্যা মামলাকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ারও সুযোগ রয়েছে।
সূত্র : প্রথম আলো, ২৭ এপ্রিল ২০২৫